পুরান ঢাকার উর্দু রোডের বাসিন্দা সত্তরোর্ধ্ব ইলিয়াস মোল্লা বললেন, ‘ঈদের আনন্দ আছিল আমাগো সময়। চকের মেলা ঈদের মিছিলের এহন আর সেই মজা নাই। চকের মেলায় মিষ্টির স্বাদ এহনো ভুলবার পারি না। মুখে লাইগা আছে।’ আর ধানমন্ডির বাসিন্দা কিশোর হাসান আবরার জানালো, ঈদের দিনে ঘুরে বেড়াতে ভালো লাগে। বন্ধু, কাজিনদের সঙ্গে। লং ড্রাইভে যেতেও ভালো লাগে তার। তবে পুরান ঢাকার ঈদের মিছিলের কথা সে শোনেনি। তবে গরমের মধ্যে এই মিছিলে যেতে সে পছন্দও করে না।
নানা বয়সের মানুষের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল সবার কাছেই তার কিশোর বয়সের ঈদের আনন্দের স্মৃতি মনের জায়গা জুড়ে রয়েছে। ঈদুল ফিতরে ঈদের আনন্দ শুরু হয়ে যায় আগের দিন সন্ধ্যা থেকেই। ঈদের চাঁদ দেখার মধ্য দিয়ে যার শুরু। এ সময় রান্না ঘরেও নানা পদ রান্নার তোড়জোড় শুরু হয়। একইসঙ্গে মার্কেটে শেষ মুহূর্তের কেনাকাটা চলে। ইদানিং শুরু হয়েছে একসঙ্গে দল বেঁধে রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়ার চল। এদিকে ঈদের দিনে নামাজ শেষে কোলাকুলি করা, বাসায় ফিরে গুরুজনদের পা ছুঁয়ে সালাম করা-এটা মুসলিম পরিবারগুলোতে রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। এরপর পরিবারের সবাই মিলে একসঙ্গে বসে খাওয়ার চল রয়েছে বেশিরভাগ পরিবারে। অনেকেই মৃত মা-বাবার কবর জিয়ারত করতে ছুটে যান কবরস্থানে। শহরকেন্দ্রিক জীবনযাত্রায় এখন ঈদকে কেন্দ্র করে গ্রামে বা জন্মস্থানে যাওয়ার নতুন ধারা সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশের মানুষের মাঝে। ফলে এই ঈদকে কেন্দ্র করে মফস্বল শহরগুলোতে, গ্রামে মিলনমেলা বসে যায়। আত্মীয়-স্বজন, স্কুলের বন্ধুদের একসঙ্গে সময় কাটানোর উপলক্ষ হিসেবে দেখা দেয় ঈদ। এসব কিছুই এখন ঈদ উদযাপনের নতুন ধারা সৃষ্টি করেছে।
ঢাকায় ঈদের দিনে সিনেমা হলগুলোতে ভিড় জমে যায়। এছাড়া বসুন্ধরা সিটি, যমুনা ফিউচার পার্কে সিনেমা দেখার জন্য মানুষের ভিড় জমে। চিড়িয়াখানা, শিশু পার্কসহ নগরীর বিনোদন কেন্দ্রগুলো জমজমাট থাকে ঈদের দিনগুলোতে।
মোগল আমলে ঢাকায় ঈদের চাঁদ দেখা নিয়ে সুবেদার ইসলাম খানের সেনাপতি মির্জা নাথান তার ‘বাহারিস্তান-ই-গায়বী’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘সন্ধ্যায় মোমবাতির আলোয় যখন নতুন চাঁদ দেখা গেল, তখন শিবিরে বেজে উঠল শাহী তূর্য। একের পর এক গোলন্দাজ বাহিনী ছুড়তে থাকে গুলি, যেন তা আতশবাজি। সন্ধ্যা থেকে মাঝরাত পর্যন্ত চলে এ আতশবাজি। শেষ রাতের দিকে বড় কামান দাগানো হয়। তাতে সৃষ্টি হয় ভূমিকম্পের অবস্থা।’ মোগল আমল ছাড়াও ইংরেজ আমলেও ঢাকায় চাঁদ দেখার এমন আয়োজন অব্যাহত থাকে। তখন ঢাকার প্রতিটি ভবনের ছাদে ছোট-বড় সবাই চাঁদ দেখার জন্য অপেক্ষা করত। চাঁদ দেখামাত্র চারদিকে আনন্দ-উত্সব শুরু হয়ে যেত।
জানা যায়, নওয়াব স্যার খাজা আব্দুল গনির (১৮১৩-১৮৯৬) সময় থেকে চাঁদ দেখা, ঈদ উত্সব পালন ও ঈদ মিছিল জাঁকজমকভাবে শুরু হয়। এরপর নবাব আহসান উল্লাহ (১৮৪৬-১৯০১) ও নবাব সলিমুল্লাহ (১৮৭১-১৯১৫) প্রমুখ ঢাকার চাঁদ দেখা ও ঈদ মিছিল পালন করেছেন। বুড়িগঙ্গা নদীর ঘাটে তাদের কিছু বজরা বাঁধা থাকত। চাঁদ দেখার জন্য সেসব বজরা ব্যবহার করা হতো। নাজির হোসেনের লেখা ‘ঢাকার ইতিহাস’ বই থেকে জানা যায়, ১৭০২ সালে মুর্শিদকুলি খান (করতলব খান) তার দেওয়ানি বিভাগ মুর্শিদাবাদে স্থানান্তর করেন। এর কিছুদিন পর মোগল সুবে বাংলার রাজধানী একেবারে পরিবর্তন করে নিয়ে যাওয়া হয় সেখানেই। ফলে ঢাকার গুরুত্ব কমে যায়। তারপর ঢাকার ওপর মূল ধাক্কা এসে লাগে ১৭৫৭ সালে ঐতিহাসিক সেই ক্ষমতার পালাবদলে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৬৫ সালে মোগল সম্রাটের কাছ থেকে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার রাজস্ব সংগ্রহের ভার পায়। ইংরেজদের রাজস্ব আদায় হতো কঠিন হাতে। ফলে পূর্ববঙ্গে প্রায়ই দুর্ভিক্ষ দেখা দিতো। ফলে সহজেই অনুমান করা যায় ঢাকাবাসীর ঈদ উদযাপন বিষয়টি সে সময় কেমন হত।
সুফি সাধক ও আরবীয় বণিকদের দ্বারা ঢাকায় ঈদ উত্সবের যে প্রচলন শুরু হয়েছিল, মোগল আমলে এসে সেই উত্সব জমকালো রূপ ধারণ করে। রাজধানীর মর্যাদা হারালেও নায়েবে-নাজিমদের আমলে ঢাকায় ঈদের চাঁদ দেখা, ঈদ জামাত, ঈদ মিছিল ও ঈদ মেলার জৌলুস বজায় ছিল। সে ধারাবাহিকতায় রং মিশিয়েছেন নওয়াবরা। প্রযুক্তির উত্কর্ষে আজ সেই উত্সবে যুক্ত হয়েছে নিত্যনতুন মাত্রা।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের পছন্দের ধরন বদলে যায়। তবে কিছু কিছু আয়োজন সময়ের গণ্ডি পেরিয়ে পরিণত হয় ঐতিহ্যে। বাঙালির ঈদ উদযাপনেও রয়েছে ঢাকার নওয়াবদের ঈদ উদযাপনের প্রভাব। উর্দুভাষী নওয়াবরা বাঈজিনাচ, মহরমের মিছিল, ঈদোত্সব, কাওয়ালি বা জয়বারী গানবাজনার প্রতি যেমন আগ্রহী ছিলেন তেমনি হিন্দুদের দুর্গাপূজা, জন্মাষ্টমী, ঝুলনযাত্রা ইত্যাদিতেও যোগ দিতেন। ঈদ উত্সবে নওয়াবরা নানা আমোদ-ফুর্তির ব্যবস্থা করতেন। যেমন কলকাতার ক্লাসিক থিয়েটারের নাটক ঢাকার নওয়াব বাড়িতে প্রদর্শন, জাদু ও সার্কাস দেখানো, বায়োস্কোপ দেখা বা কোন খেলাধুলার আয়োজন। ঈদ উত্সবে পাটুয়াটুলির ক্রাউন থিয়েটার, জগন্নাথ কলেজ, ন্যাশনাল মেডিক্যাল ইত্যাদির মঞ্চে বায়োস্কোপ দেখার প্রতি মানুষের আগ্রহ যেমন ছিল তেমনি পিকচার হাউস, এম্পায়ার থিয়েটার ইত্যাদিতে সিনেমা উপভোগের কথা জানা যায় নওয়াব পরিবারের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে। নওয়াবেরা ঈদের এমন সব বিনোদনে অংশগ্রহণের জন্য পরিবারের ছেলেমেয়েদেরও সুযোগ করে দিতেন । ঈদসহ নানা পালা-পার্বণে ঢাকার নওয়াবদের মহল এবং পরিবার ঘিরে সৃষ্টি হওয়া সাংস্কৃতিক চাঞ্চল্য শেষ পর্যন্ত নওয়াবি সীমানা ছাড়িয়ে সাধারণ ঢাকাবাসীর মাঝেও বইয়ে দিয়ে যেত আনন্দের হল্লা। সব মানুষের মিলিত অংশগ্রহণে ঢাকা পরিণত হতো সর্বজনীন উত্সবের নগরে।
আমরা সবাই জানি, মুসলমানদের দুটি প্রধান উত্সব হচ্ছে ঈদুল ফিত্র ও ঈদুল আজহা। রমজান শেষে ঈদুল ফিত্র পালিত হয়। ঈদের সামাজিক অর্থ উত্সব, আর আভিধানিক অর্থ পুনরাগমন বা বারবার ফিরে আসা। অন্যান্য সামাজিক উত্সবের মতো ঈদও বারবার ফিরে আসে। মোগল আমলে ঈদের দিন যে আনন্দ উদযাপন হতো তা উচ্চপদস্থ এবং ধনাঢ্য মুসলমানদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, তার সঙ্গে সাধারণ মানুষের ছিল ব্যবধান। তবে মোগলরা যে ঈদের গুরুত্ব দিতেন তা বোঝা যায় বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় শাহী ঈদগাহর ধ্বংসাবশেষ দেখে। উনিশ শতকের শেষ দিকে ঈদের আনুষঙ্গিক আনন্দ হিসেবে যুক্ত হয় লোকজ মেলা। সে ধারা আজও অব্যাহত রয়েছে। বর্তমানে ঈদ উপলক্ষে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অসংখ্য মেলা বসে। তাছাড়া গ্রামাঞ্চলে বড় ঈদ জামায়াতকে কেন্দ্র করে বিশাল মেলা বসে যায়। যা প্রায় দিনভর চলতে থাকে।
ঈদ উদযাপনের আরেকটি বড় অনুষঙ্গ মজাদার খাবারের আয়োজন। ঘরে ঘরে সেমাই রান্না করা তো ঈদের অন্যতম অনুষঙ্গ। অন্য খাবারের মধ্যে থাকে কোরমা-পোলাও, পায়েস, জর্দা, পিঠা প্রভৃতি। ঢাকায় উনিশ শতকে ঈদের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল ঈদ মিছিল। সম্ভবত ঢাকার নায়েব-নাজিমগণ ঢাকার বিখ্যাত জন্মাষ্টমী মিছিলের অনুপ্রেরণায় এ মিছিল চালু করেছিলেন। কিছু সময় বন্ধ থাকার পর আবার এ মিছিল চালু হয়েছে। বিশ শতকের ত্রিশ-চল্লিশ দশকে ঢাকায় ঈদের দিন রমনা, আরমানিটোলা বা অন্যান্য মাঠে ‘খটক’ নাচ অনুষ্ঠিত হতো। এছাড়া ছিল নৌকা বাইচ, ঘুড়ি ওড়ানো, ঘোড়দৌড়, হিজরা নাচ ইত্যাদি। ঘোড়দৌড় ও হিজরা নাচ ছিল ঢাকার বাবু কালচারের অঙ্গ, যা যুক্ত হয়েছিল ঈদ উত্সবের সঙ্গে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান হওয়ার পর বাংলাদেশে দুটি ঈদই জাতীয় ধর্মোত্সবে রূপান্তরিত হয় এবং রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পায়।
ঈদগাহে ঈদ জামায়াত: উনিশ শতকের শেষদিক থেকে শুরু করে বিশ শতকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত নওয়াববাড়ি থেকে দেওয়া তোপধ্বনিতে চাঁদ ওঠার খবর পেত ঢাকাবাসী। শুরু হতো ‘চানরাত’। ঢাকাবাসীর রেওয়াজ ছিল দল বেঁধে ঈদের নামাজ পড়তে যাওয়া। ঢাকার সবচেয়ে প্রাচীন ঈদগাহ ছিল ধানমন্ডির সাতমসজিদ রোডে, যেটি নির্মিত হয়েছিল ১৬৪০ সালে। পুরনো ভগ্নাবশেষকে পুনর্নির্মাণ করে বর্তমানে এখানে নিয়মিত ঈদের জামাতের আয়োজন করা হয়।
ঈদের পাঞ্জাবি: ঈদের নতুন পোশাক বিষয়ক ভাবনাটা মূলত ঢাকার বিত্তশালীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। নওয়াবদের কোট, শেরওয়ানি, আচকান বানাতেন জিন্দাবাহারের কিংবদন্তিতুল্য দর্জি হাফিজ মিঞা। এত দক্ষ ছিলেন যে কারো শরীরের মাপ নিয়ে নয়, চেহারা একবার দেখে সে অনুসারে কাপড় কেটে শেরওয়ানি সেলাই করতেন। এছাড়া সে সময়ে বিখ্যাত ছিলেন আমলিগোলা মহল্লার রহমান খলিফা, ইসলামপুরের মতি খলিফা। তাঁদের উত্তরসূরি বশিরউদ্দিন। নিউ মার্কেটের বশিরউদ্দিন টেইলার্স এখনো মরহুম বশিরউদ্দিনের ঐতিহ্য বহন করে চলছে।
বিভিন্ন ব্যক্তিদের স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, ‘বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকের আগ পর্যন্ত মুসলিম পুরুষরা ধুতি পরেই ঈদের নামাজ পড়তে যেতেন। তখন নামাজে দাঁড়িয়ে ধুতির কোচা খুলে ফেলতেন তাঁরা। পরে ধুতির বদলে লুঙ্গির প্রচলন শুরু হয়। পাশাপাশি পায়জামা-পাঞ্জাবিও পরতে শুরু করে ঢাকাবাসী। বিশেষ করে ঈদের সময় পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা নিয়ম হয়ে দাঁড়ায়। পুরুষরা পরতেন সাদা ফুটফুটে গিলে করা আদ্দি কাপড়ের পাঞ্জাবি।
কাগজের টুপি ও আতরমাখা তুলা : সেকালে ঈদের নামাজের জন্য হাতে রঙ করা কাগজের টুপি তৈরি করা হতো। অসচ্ছল ও শ্রমিক শ্রেণিই সাধারণত এ টুপি কিনত। গোলাকৃতি এ টুপির দাম ছিল চারআনা থেকে আটআনা। কয়েকবার ব্যবহারে নষ্ট হয়ে গেলেও এর বেশ কদর ছিল। ফ্যাশনের আরেকটি আবশ্যিক পর্ব ছিল ঈদের আগের দিন চুল কাটা। সে সময় স্টাইল ছিল দিলীপ কাট। চুল কাটার আরেকটি স্টাইল ছিল দশআনা-ছয়আনা। অর্থাত্ সামনে বড় আর চারপাশে ছোট। পর্দাপ্রথার কারণে সাদা ফুলস্ক্যাপ কাগজে পায়ের পাতার মাপ এঁকে দিত বাড়ির মেয়েরা। তাই দেখে বাড়ির পুরুষরা স্যান্ডেল কিনে আনত। লায়ন সিনেমা হলের বিপরীতে ছিল ‘ফিং ফোং’ নামে একটা চীনা মুচির জুতার কারখানা। এ দোকান থেকেই সরবরাহ করা হতো বিত্তশালী নারীদের স্যান্ডেল আর পুরুষদের জুতা। আদি ঢাকাবাসীর ঈদের আরেকটি ঐতিহ্য ছিল আতরমাখা। যে কারণে প্রতিবছর ঈদের আগে জমজমাট হয়ে উঠত আতরপট্টি। দরবারিখাস, মিশকাম্বর, মেশক-জাফরান, গোলাপখাস হরেক রকম নাম ছিল এসব আতরের। আতরমাখা তুলা কানের ভাঁজে গুঁজে ঈদের নামাজ পড়তে যাওয়া ছিল ঢাকাবাসীর স্বকীয়তা।
চানরাতে চুড়িওয়ালী : ঈদ উপলক্ষে ইসলামপুর থেকে কাপড় কিনে তাদের বাড়িতে তৈরি করা হতো মেয়েদের সালোয়ার-কামিজ, দোপাট্টা ইত্যাদি। বাড়ির মেয়েরা যা সেলাই করত নিজস্ব সেলাই মেশিনে। বাজার থেকে শাড়ি কিনে এনে শাড়ির ওপর এমব্রয়ডারি, পুঁতির কাজ, বর্ডার (পাইপিং) দিয়ে শাড়িকে আকর্ষণীয় করা হতো। বিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত ঈদে ঢাকাবাসী নারীদের ফ্যাশনের অন্যতম অনুষঙ্গ ছিল ‘চানরাতে’ চুড়িওয়ালীদের কাছ থেকে চুড়ি কেনা এবং তাদের হাতে চুড়ি পরা। বাঁশের টুকরি মাথায় করে বাড়ি বাড়ি যেতেন চুড়িওয়ালীরা। বাড়ির ছোট থেকে বড় সবাই চুড়িওয়ালীদের হাতে চুড়ি পরত। চুড়িহাট্টা পল্লী জোগান দিত এ চুড়ির। রমণীদের পছন্দ ছিল সোনার বালার সঙ্গে মিলিয়ে রঙিন কাচের চুড়ি পরা। আর ২৭ রমজান থেকে অন্দরমহলে মেহেদি রাঙানো শুরু হয়ে যেত। বিশেষ করে ‘চানরাতে’ মেহেদি উত্সব চলত পুরো শহরে। মেহেদিপাতা বেটে তখন হাত রাঙানো হতো। ‘আমরা ঢাকাবাসী’ সংগঠন এখনো নিয়মিত মেহেদি উত্সব পালনের মধ্য দিয়ে মেহেদির নকশার ঐতিহ্য ধরে রেখেছে।
হাতে বানানো সেমাই : ঈদ উপলক্ষে প্রতিটি বাড়িতেই বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা করা হতো। চানরাতে মহল্লার বাড়িতে বাড়িতে সেমাই রান্নার ধুম পড়ে যেত। হাতে ঘোরানো কলে তা তৈরি হতো। বাড়িতে সেমাইয়ের কল ব্যবহার করাটা ছিল আভিজাত্যের পরিচায়ক। ঈদের সকালে অভিজাত ঢাকাইয়া পরিবারের খাবার টেবিলে হাতে বানানো সেমাই এখনো পাওয়া যায়। তখনকার দিনে ঢাকায় বিত্তশালীদের বাড়িতে থাকত বৈঠকখানা। এ বৈঠকখানায় দিল্লি বা লখনউ থেকে আনা সুগন্ধি ব্যবহার করত অনেকে। গোলাপজল ছিটিয়ে আগত অতিথিদের অভ্যর্থনা জানানো হতো এবং ব্যবস্থা করা হতো ব্যয়বহুল ২৪ পদের তোরাবন্দি খাবার। নওয়াব আমলে অভিজাত নাগরিকরা ঈদের দিন বিকালে মিলিত হতেন ‘আহসান মঞ্জিলে’। বাইশ পঞ্চায়েতের সর্দারদের দাওয়াত করা হতো সে মজলিসে।
ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ঈদ মিছিল : ঈদ উত্সবের আরেকটি আকর্ষণ ছিল ঈদের মিছিল, যার শুরু সুবাদার ইসলাম খাঁর সময়ে। এ ধারাবাহিকতায় নিমতলী প্রাসাদে বসবাসকালীন নায়েব-নাজিমদের সময়েও অনুষ্ঠিত হতো ঈদের মিছিল। উনিশ শতকের শুরুতে আলম মুসাওয়ার নামে চিত্রশিল্পীর আঁকা ছবিতে তার প্রমাণ মেলে। নায়েব-নাজিমদের বংশ লুপ্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঈদের রাজকীয় মিছিল প্রাণ হারায়। উনিশ শতকের তৃতীয় দশক থেকে ঢাকায় আবার ঈদের মিছিল চালু হয়। এই ঈদ মিছিল কখনো হতো ঈদের পরদিন, আবার কখনো বা ঈদের দিন বিকালে। উর্দু রোডের হিন্দু মন্দিরের কাছে থাকত হিন্দু ধোপারা। তারা ঈদের মিছিলে সং সেজে বাদ্যের তালে তালে নেচে গান গাইত- ‘আও আও মিলকে চালে হিন্দু-মুসলমান / দুনো হাম হায় পাড়োশি, ঝগড়া কাহেকা/।’
ঈদমেলা ও ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতা : চকবাজার, রমনা ময়দান, আরমানিটোলা, ধূপখোলা মাঠ, পল্টন ময়দানসহ ঢাকার আরো কয়েকটি জায়গায় ঈদের দিন মেলা বসত। সবচেয়ে বড় মেলাটি বসত চকবাজারে। ঈদের দিন বিকালে ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতা হতো গনি মিয়ার হাট, রমনা মাঠ, পল্টন ময়দান, শহীদনগরের চর, কামরাঙ্গীরচর কিংবা নওয়াববাড়ির মাঠ ও পাকা ঘরের ছাদে।
ঈদের সালামি : ঈদের দিনে নামাজের পর গুরুজনদের সালাম করে শিশু-কিশোরদের কাছে সবচেয়ে আকার্ষণীয় পর্ব ঈদ সালামি আদায়। পরিবারের বড় সদস্যদের কাছ থেকে ঈদ সালামি আদায় করা শিশু-কিশোরদের কাছে ঈদের দিনের প্রধানতম আনন্দের উপলক্ষ। সালামি আদায়ের পর কে কত টাকা পেল সে নিয়ে আড্ডায় সরব হয়ে ওঠে এসব খুদে বাহিনী।